।। অমর নাথ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার।।
নগ্ন চরিত্
-সুজিত চট্টোপাধ্যায়
দু পেগ হুইস্কির পর প্রতীক্ষায় নায়ক। হোটেলের লাক্সারি রুমে মক্ষি আসবে। হুইস্কির ট্রে রেখে যাবার সময় আব্বাস বলে গেছে।
দরজায় ঠকঠক তিনবার। খুলে দিতে হবে দরজা। ইচ্ছে করলে রাতভর। বেপরোয়া আমেজের বাঁধভাঙ্গা বন্যা।
খরচ একটু বেশি। পরোয়া নেই। সুখ চাই সুখ। বেপরোয়া দুরন্ত রঙিন শরীর সুখ।
শরীর সুখ কেনা যায়। বিক্রি হয়। হাতবদল হয়। শুধু টাকা চাই, টাকা।
আব্বাস এই হোটেলের রুমবয়। খদ্দেরদের কাছে সুখ বেচার করিৎকর্মা দোকানদার। নরকের জলজ্যান্ত দূত। অন্ধকারের যাত্রী।
স্বভাব গুণে কিংবা দোষে, যার যে জিনিসের অভাব বোধ, তা-ই পেতে আকুল হয় মন। খিদে। এ খিদে সাংঘাতিক খিদে। না খাওয়া অবধি নিস্তার নেই। ছটফটানি, আকুলিবিকুলি । তার ওপর পেটে মাল পড়লে তো কথাই নেই। আগুন দ্বিগুণ। দাউদাউ লেলিহান লালসার দাবানল।
দুরছাই এতো দেরি কেন , আব্বাস, জলদি করো বাপধন, এসব ব্যাপারে অপেক্ষা টপেক্ষা ধাতে সয় না। যাও,, মক্ষি লাও , সাথ মে চিকেন তন্দুরি। সব খাউঙ্গা। জি ভর কে। যাও, জলদি করো।
হা হা, শালা , বউ জানে তার স্বামী সি আই ডি তে ডিউটি করে ।
ধুস,বোকার মাদুলি। শালী জানেই না,সে একটা প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে ইনফর্মার কাম ফটোগ্রাফারের কাজ করে।
জানবার দরকার কী? কিচ্ছুটির তো অভাব রাখা হয়নি। না চাইতেই সকল ইচ্ছে পূরণ হয়ে যাচ্ছে। খাওয়া , ঘোরাঘুরি , বিউটি পার্লার , ফ্যাশনের স্মার্টফোন , জমকালো চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের পোশাক,, আবার কী চাই ! হেঁ হেঁ ব্বাবা,, স্বামীর কর্তব্যের খুঁত খুঁজে পাবেনা ।
দশম বিবাহবার্ষিকী পালন হয়ে গেছে।
পুরাতন প্রেম এখন বিশ্রামে আছে।
তাছাড়া , সত্যি কথা বলতে কী,, ওয়াশিং মেশিনে কাচা , আর নতুন আনকোরা শাড়ির মধ্যে তফাৎ তো থাকবেই। একটা অন্যরকম অনুভূতির ছোঁয়া। অদ্ভুত ভাললাগা। অস্বীকার করার উপায় নেই প্রিয়ে।
সামাজিক ইজ্জতদার আদমি। অনেককিছুই খুল্লামখুল্লা করা যায় না।
পর্দা হ্যায় , পর্দা হ্যায় । পর্দে কে পিছে…
শাল্লা,, বুজরুকি ভরঙের জগৎ। ঠাটবাট বজায় রাখো শিবের বাবাও সন্দেহ করবেনা।
ভুয়ো মালের জমানা।
আই এ এস,
আই পি এস থেকে সি বি আই , সি আই ডি, ডাক্তার, সব ভুয়ো।
গাড়ির মাথায় নীল বাতির চড়কি ভেঁপু।
হঠ যাও,, ভি আই পি, আ রহা হ্যায়।
হাঃ হাঃ,,
আসল নকল একাকার হয়ে গেল রে, একাকার হয়ে গেল।
গোয়েন্দা এজেন্সিতে টু পাইস ফালতু কামাই করার মাওকা আছে ।
পার্টি বুঝে ছোটখাটো ব্ল্যাকমেইল করে টুকটাক আদায় করা যায় ।
আরে বাবা উবরি না থাকলে , বাড়তি ফুর্তির রসদ কোত্থেকে জুটবে শুনি ।
হিসেব ক’রে ফুর্তি জমে না । বেহিসেবি লটরপটর স্বর্গসুখের সমান। উবরি চাই উবরি। টানকে মতিলাল,,,।
দেব রাজ ইন্দ্র , সন্ধ্যেবেলা স্বর্গে বসে কী করে ?
বাতি জ্বেলে গীতা পাঠ করে ? ধুস…
সোমরস ঢুকু ঢুকু সঙ্গে অপ্সরাদের উদোম নেত্য।
চালাও পানসি।
তবে কি-হয় , মানে,, এইসব উৎপটাং কাজ করতে করতে , স্বভাবের বারোটা বেজে যায়।
মা কালির দিব্যি। একদম বারোটা বেজে পাঁচ,
কিন্তু , একটু রিস্ক তো নিতেই হবে পাঁচু ।
নইলে এই মাল খাওয়া , হোটেলের ঘরে মক্ষি নিয়ে ফুর্তিফার্তা , জুটবে কোত্থেকে শুনি ।
না না, বিশ্বাস করো , এসব একেবারেই ছিল না। মাইরি ।
পাক্কা ডালভাত জীবন। বউ ছাড়া নো এন্টারটেইনমেন্ট। বউ, মাই ডারলিং,,
ও-ই যে মেয়েটা বাড়িতে কাজ করতো , মালতী। ওর ফিগার, ওফ্ফ, কী দারুণ। ভাবা যায় না। কিন্তু না, আড়চোখে একটু আধটু দেখা ছাড়া অন্য কিচ্ছুটি নয়।
এই চোখ ছুঁয়ে বলছি ।
কিন্তু , ও-ই যে বললুম । স্বভাবের মধ্যে একটু একটু করে উইপোকা’র বাসা বাঁধলে দেবতাও হড়কে যায়। মানুষ তো কোন ছার।
সেদিন, রান্নাঘরে, পেছন থেকে আচমকা, মালতীর , আয় আয় ক`রে ডাকা কোমর , জাপটে ধরতেই হুলুস্থুল কান্ড।
মালতীর বেমক্কা আর্তনাদে , পাড়া শুদ্ধ লোকের কাছে , প্রেস্টিজ টিউব ফটাশ পাংচার। বউয়ের চোখে আগুন , মুখে হরপা বান।
পালাবার পথ নাই , নাইরে ,
তোর যম আছে পিছে ।
মুখপোড়া হনুমান হয়ে ল্যাজ গুটিয়ে, নায়ক তখন কুঁইকুঁই কুত্তা ।
মনে খিস্তির বান চলছে ,,,
আরে , সায় নেই চুপচাপ সরে যা,, চ্যাঁচামেচি করে কী প্রমাণ করতে চাইলি ? সতীপনা, সতীসাধ্বী সাজছে । কী ক্ষতি হতো , একটু
ইমু ইমু করলে ? ওরে , অত দেমাগ ভালো নয়। জগতে কিছুই টেঁকসই নয়। সব ধ্বসে যাবে।
সময় গেলে ছিবড়ে হয়ে পড়ে থাকবি।
ষাঁড়ও ছোঁবে না।
উত্তেজনা , ডিপ ফ্রিজে কেৎরে শুয়ে পড়ে রইলো । জারিজুরি ভ্যানিশ। মাঝখান থেকে,
মালতী মোটা মাল হাতিয়ে নিয়ে কেটে গেল ।
মুখ বন্ধের ভরতুকি । সামাজিক কেচ্ছা ঠেকানোর মোক্ষম দাওয়াই । টাকা । আক্কেলসেলামি। টাকায় কি না হয়?
সেই থেকে বউ , আর রিস্ক-এর মধ্যে নেই । প্রমাণ হয়ে গিয়েছে , স্বামী , লুজ কারেক্টার ।
এখন , বুড়ী কেতোর মা , মালতীর জায়গায় বহাল। বউয়ের ভাবখানা এমন , যেন বলতে চাইছে ,
নে, এবার কী করবি কর। গুনগুন ক’রে গানের সুর ভাঁজছে,
এ নদী এমন নদী , জল চাই একটু যদি ,
দু হাত ভরে শুখনো বালু দেয় আমারে,,
নায়কের ওপর থেকে বিশ্বাস ভ্যানিস।
এইজন্যেই ঘরে ছুঁড়ি ঢোকাতে নেই । পুরুষের নোলা , সাপের চেয়েও বিষাক্ত।
শিয়ালের মতো ধূর্ত , বেড়ালের মতো ছোঁকছোঁকে।
সব পুরুষ সমান । ডবকা মেয়ে দেখলে,
গাল দিয়ে নাল গড়িয়ে পড়ে।
ঘি , কিছুতেই আর ঘরে আনবো না । আগুন দিয়ে কী গলাবি গলা ।
কিন্তু ভদ্রমহিলা এটা জানেন কি, পুরুষের অনেক রাস্তাই খোলা !
ঘরে মাংস না থাকলে রেস্তোরাঁ খোলা আছে। ঘরের কফিতেই যদি পরিপূর্ণ তৃষ্ণা মিটতো , তাহলে কেউ কফিশপে যেতোনা ।
পকেটে রেস্তো থাকলেই হলো। বাড়তি খরচ তাই বাড়তি রেস্তো। নো রিস্ক , নো গেইন।
ইচ্ছে থাকলেই হবে ? নাহী চাঁদু ।
সাহস চাই সাহস ।
ন টা বেজে গেছে । আব্বাসটা কী করছে ?
দুর,, ভাল্লাগে না।
নায়ক অস্থির হয়ে ইন্টারকম তুলতে যাবে , ঠিক তখনই দরজায় টোকা। ঠক ঠক ঠক। গুনে গুনে তিন বার। এই সেই প্রতিক্ষার ঈঙ্গিত।
মক্ষি হাজির।
নেশায় টলমল পা। দরজা খুলে, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা অপ্সরার দিকে তাকিয়ে নায়কের নেশায় আচ্ছন্ন চোখ প্রায় কপালে।
এ কী,,, তুমি,,, তুমি কীভাবে,, এখানে ??
মালতী , ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে করতে চটুল ভঙ্গিতে বললো,
কেন , আসতে নেই ? আমি তো তোমার পছন্দই। রান্নাঘরে জাপটে ধরার কথা ভুলে গেলে নাকি ? তাহলে ?
সেই মালতী , আর এই মালতী ? এ যে আরও প্রাণঘাতি। মনে অশ্বমেধের ঘোড়া দৌড়চ্ছে।
নরক মনের বিশাল লোহার কড়াইয়ে তেল গরম হয়ে ফুটছে ,, টগবগ টগবগ টগবগ ।
মালতী নিজেকে আরও খোলামেলা করে , বিছানায় কাম মোহিনী শরীর বিছিয়ে দিয়ে, সুর করে বললো ,,,
এসো,, প্রাণভরে সখ মিটিয়ে নাও।
স্বর্গসুখ,, ভোগ করো। এসো।
ঠিকই বলেছে মালতী ।
স্বর্গসুখ ভোগকরো। ঠিক । কেনা সুখের আবার বাছবিচার কী? এসো,, আদিম হও।
ভুয়ো ভাললাগা , শরীর ধুলেই পরিষ্কার।
হালকা নীলচে আলোয় , মালতী এখন কামাতুর ভুয়ো নায়কের , নগ্ন নায়িকা । রাত শেষ না হওয়া পর্যন্ত।।
সমাজ দর্পণ